১. সংস্কৃতি ও পহেলা বৈশাখ
সাধারণত সংস্কৃতি বলতে বুঝি, “কোন ভৌগলিক অঞ্চলের মানুষগণ ব্যাক্তি চেতনাবোধ থেকে যা পালন করে থাকে তাই ঐ অঞ্চলের সংস্কৃতি।” কোন অঞ্চলের নিয়ম-নীতি, ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান, ভাষা-সাহিত্য, পোশাক, সংগীত আরও অনেক উপাদান নিয়ে গঠিত ঐ অঞ্চলের সংস্কৃতি। আর এ সকল উপাদান আপনা-আপনি প্রচলিত হয়ে যায়নি, কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা উদ্ভবের মাধ্যমে গোটা অঞ্চল বা জাতিতে এদের বিকাশ ঘটেছে। এদের মধ্যে কিছু নিজেদের সৃজনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়ে গণমানুষে যা বিকশিত হয়েছে তাকে আমরা বলি মৌলিক সংস্কৃতি, আবার অন্য কোন জাতি বা গোষ্ঠী থেকে ধার করে নিজেদের মধ্যে যেগুলো বিকশিত হয়েছে সেগুলোকে বলি ধার করা বা অপসংস্কৃতি (উদাহরণ দিলে ইংরেজি নববর্ষের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে)। এদিক দিয়ে ‘পহেলা বৈশাখ’ একান্তই আমাদের মৌলিক সংস্কৃতি।
২. পহেলা বৈশাখের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
সম্রাট আকবরের হাত ধরে ১৫৮৪ সালে বাংলা সাল প্রবর্তিত হয়। আমাদের কৃষি ব্যবস্থা ঋতু নির্ভর। চন্দ্র বর্ষ, সৌর বর্ষের চেয়ে ১০-১২ দিন কম হওয়ায় খাজনা আদায় করতে অসুবিধে হত, এই অসুবিধে দূর করার জন্য পারস্যের বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ ফতুল্লা সিরাজীকে নিয়োগ করেন এবং তার সুপারিশেই তিনি বাংলা সাল প্রবর্তন করেন। কিন্তু সাল গণনা শুরু করেন তাঁর সিংহাসন আরোহণের সাল থেকে (ইংরেজি ১৯৫৬ সাল, হিজরি ৯৬৩ সালে), ঐ হিসেবে ১৯৫৬ সালে বাংলা সালের প্রথম বর্ষ হওয়ার কথা কিন্তু হিজরি সালের সালের সাথে মিল রেখে ৯৬৩ সাল থেকেই বাংলা সন গণনা করা হয়। এই নাতুন সনটি ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল পরবর্তীতে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত পায়।
৩. হালখাতা প্রচলন
ঐ সময়ে পুণ্যাহ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রজারা খুশি মনে জমিদারদের বাকি-বকেয়া সাধ্যমত পরিশোধ করতো, আর জমিদাররা তাদের মিষ্টিমুখ করাতো, এটিই পরবর্তীতে হালখাতা রুপে পরিচিতি পায় ব্যবসায়ীদের কাছে। পুরনো হিসেব-নিকাশ চুকিয়ে নতুন খাতা খুলে আর ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে উদযাপন করা হয় হালখাতা অনুষ্ঠান, যা ব্যবসায়ীরা এখনো পালন করে যাচ্ছে।
৪. পান্তা-ইলিশ ও বৈশাখী মেলা
কৃষকরা যেহেতু এই দিনে দাঁয় মুক্ত হত তাই তারাও ছোটখাটো উৎসব পালন করতো। আর এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বসতো গ্রামীণ সমাজের লোকজ মেলা।স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য-পন্য, কারুপন্য, কুটিরশিল্পজাত সামগ্রী, হস্তশিল্প থেকে শুরু করে শিশু –কিশোরদের খেলনা, পালাগান, জারিগান, সারিগানের সমারোহে উজ্জীবিত হয়ে উঠত এই মেলা। তৎকালীন গ্রামীণ সমাজে লঙ্কা-ভাত কিংবা মাছ-ভাত যোগাতে অনেক বেগ পোহাতে হত সেসময়ে ভালো খাদ্য বলতে পান্তা-ইলিশ বুঝাতো, আর উৎসবের দিনে সবাই একটু হলেও ভালো খাদ্য খাওয়ার চেষ্টা করতো, নতুন বছরে তারা ভালো খাদ্য হিসেবে এই পান্তা-ইলিশ খেত।
সর্বজনীনভাবে এই পান্তা-ইলিশ কে ঐতিহ্য হিসেবে ধরে রাখতেই এই রীতি প্রচলিত হয়ে আসছে। আর নগর জীবনে নারীরা শাড়ি, হাতে চুড়ি, খোঁপায় ফুল আর পুরুষরা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে ঘুরতে বের হত গ্রামীণ সমাজের বৈশাখী মেলায় আর বৈশাখকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে।
৪. রমনা বটমূল, মঙ্গল শোভাযাত্রা ও অন্যান্য
সংস্কৃতি যেহেতু গতিশীল সেহেতু নতুন বর্ষের প্রথম দিন কে কেন্দ্র করে যুক্ত হতে থাকে নতুন নতুন আঁচার-অনুষ্ঠান, নিয়ম-রীতি; একসময় তা পালিত হতে থাকে সর্বজনীনভাবে। এই সর্বজনীনভাবে পালিত অনুষ্ঠান সমষ্টির নাম হয়ে উঠে আজকের এই ‘পহেলা বৈশাখ’ উৎসব।
১৯৬৭ সালে সর্বপ্রথম ছায়ানট রমনার বটমূলে রবীন্দ্রনাথের বৈশাখী আগমনী গান ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ -এর মাধ্যমে চমকপ্রদ ও জমজমাট জনাকীর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বর্ষকে বরণ করা শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদও বকুল তলায় প্রভাতী অনুষ্ঠানে জন সমুদ্রের ঢেউয়ে আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেয় নতুন বছরকে, অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় পালন করা হয় নববর্ষ।
দেশজ লোকজ সংস্কৃতি উপস্থিতির মাধ্যমে সব শ্রেণীর মানুষকে একত্রিত করার লক্ষে ১৯৮৫ সালে যশোরের ‘চারুপীট’ নামের সাংস্কৃতিক সংঘটন প্রথমবারের মত বর্ষবরণ করতে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে, নান্দনিক এই শোভাযাত্রা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে প্রথম বারের মত আয়োজন করা হয় আনন্দ শোভাযাত্রা। ১৯৯৫ সালের পর শিল্পী ইমদাদ হোসেন এর হাত ধরে আনন্দ শোভাযাত্রা নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। অশুভ শক্তিকে তাড়িয়ে প্রগতিশীলতাকে বিকাশ করাই হল এই শোভাযাত্রার লক্ষ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা চারুকলা অনুষদ থেকে বাঙ্গালির লোকজ নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক, প্রাণীর প্রতিকৃতি ও মুখোশ নিয়ে শোভাযাত্রা বের হয় অমঙ্গলকে দূর করার জন্য আর তাতে যোগ দেয় নানা শ্রেণীর মানুষজন।
৫. পরিশেষে
উপরিউক্ত আলোচনায় স্পষ্টতো পহেলা বৈশাখ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের মৌলিক সংস্কৃতি। আর বাঙালিরা এই উৎসব পালন করে বিধায় নানাজন নানা কথা বলে, নিষেধ করা হয়, কিন্তু কেন? মৌলিক সংস্কৃতিতে বা মৌলিকত্ত্বে মিশে থাকে ব্যাক্তির ঐতিহ্য, চেতনা, ভালোলাগা ও ভালবাসা। সেই চেতনাবোধ থেকে পালন করা হয় বৈশাখের এতসব আয়োজন। আর কর্ম জীবনের দীর্ঘ দিনের ক্লান্তি, জীবনের হতাশা-নিরাশা থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন আনন্দে সামিল হওয়া আর আনন্দের জন্য প্রয়োজন সর্বজনীন উৎসব, আর তা হল আমাদের পহেলা বৈশাখ। তাছাড়া, যত বেশী টাকা সার্কুলেশন হয়, একটি দেশের অর্থনীতি তত উন্নত হয়। আর এই উৎসব কে কেন্দ্র করে যে পরিমাণ টাকা সার্কুলেশন হয় তাতে দেশে অর্থনীতির সূচক বাড়ে, ব্যবসায়ীরা থেকে গরীব জেলে-কৃষক পর্যন্ত লাভবান হয়। তার জন্যও হলেও প্রয়োজন বৈশাখ উৎসবের।
আর এমনিতে আমাদের সংস্কৃতিতে অপসংস্কৃতির মিলন মেলা, কিন্তু বৈশাখ উৎসবের অনুষ্ঠানগুলো আমাদের মৌলিক সংস্কৃতি। তো নিষেধ কেন? আপনাদের ইচ্ছে না হলে ঘরে বসে থাকুন, চুপ করে থাকুন, অন্যকে পালন করতে নিষেধ করার কি যুক্তিকতা!!
হয়ত বলবেন, বৈশাখ উৎসবকে কেন্দ্র করে কিছু অপরাধ কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়, সেটা কি উৎসবের ব্যর্থতা নাকি প্রশাসনের? চোর তো চুরি করবেই, চুরি ঠেকানো প্রশাসনের কাজ, সাধারণের নয়।
সবাইকে ‘শুভকামনা’ ও ‘নববর্ষের শুভেচ্ছা’।।
১৩-০৮-২০১৮
No comments:
Post a Comment